কিডনি রোগ: লক্ষণ, কারণ ও প্রতিরোধের পুরো রোডম্যাপ
কিডনি রোগ: লক্ষণ, কারণ ও প্রতিরোধের পুরো রোডম্যাপ
কিডনি রোগ কি?
কিডনি (Kidney) হলো আমাদের দেহের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ, যা রক্ত থেকে বর্জ্যপদার্থ (waste), অতিরিক্ত পানি ও বিভিন্ন খনিজ পদার্থ ছেঁকে মূত্র (urine) তৈরি করে দেহকে পরিষ্কার রাখতে সাহায্য করে। এছাড়া, কিডনি রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ, রক্তকণিকা উৎপাদন, ও হরমোন নিয়ন্ত্রণেও ভূমিকা রাখে।
কিডনি রোগ (Kidney Disease) তখন হয় যখন কিডনির কাজ ধীরে ধীরে অথবা হঠাৎ (acute বা chronic) ব্যাহত হয়, ফিল্টারিং ক্ষমতা কমে যায়।
![]() |
Are Your Kidneys OK? |
কিডনি রোগের ধরণ ও তাৎক্ষণিক ধাপ
ধরণ:
- একিউট কিডনি ইনজুরি (Acute Kidney Injury, AKI): হঠাৎ onset, দ্রুত চিকিৎসা নিলে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে পারে।
- ক্রনিক কিডনি ডিজিজ (Chronic Kidney Disease, CKD): ধীরে ধীরে বাড়ে, সময়ের সাথে কিডনির কাজ কমে যায়; অনেক সময় লক্ষণ শুরুতে স্পষ্ট হয় না।
- অন্যান্য বিশেষ ধরণ: পলিসিস্টিক কিডনি রোগ (Polycystic Kidney Disease), হাইপারটেনসিভ কিডনি ডিজিজ, কিডনিতে পাথর, গ্লোমেরুলোনেফ্রাইটিস ইত্যাদি।
![]() |
Stages of CKD |
স্টেজ (Stages) (CKD-এর ক্ষেত্রে):
CKD সাধারণত ৫টি ধাপে ভাগ করা হয়, যেখানে ধাপ ১ ও ২-তে কিডনির কাজ প্রায় স্বাভাবিক থাকে, ধাপ ৩-৪-এ মধ্যম/গুরুতর ক্ষতি, ধাপ ৫ এ “এন্ড স্টেজ রেনাল ডিজিজ (End-Stage Renal Disease)” যেখানে ডায়ালাইসিস বা ট্রান্সপ্লান্ট প্রয়োজন হতে পারে।
লক্ষণসমূহ — কখন বুঝবেন কিছু ভুল হচ্ছে?
নিচে এমন কিছু লক্ষণ দেয়া হলো যা দেখা দিলে দ্রুত ডাক্তার দেখাতে হবে:
- প্রস্রাবের পরিবর্তন: বেশি বা কম প্রস্রাব হওয়া, রাতে প্রায় ঘুম ভেঙে প্রস্রাব লাগা, রক্ত মেশানো বা গরম প্রস্রাব।
- মুখ, পা, দাঁত বা গোড়ালি ফুলে যাওয়া (Edema)।
- গায়ে অতিরিক্ত ক্লান্তি, শক্তিহীনতা, ঘুম কম হওয়া।
- বমিভাব, বমি, পেট ব্যথা বা খাবার হজমে সমস্যা।
- ঘ্রাণ ও স্বাদে পরিবর্তন, মনোযোগ কেন্দ্রীকরণে সমস্যা।
- ত্বক শুষ্ক হওয়া, চুলকানি, কখনো কখনো শ্বাসকষ্ট বা নিশ্বাসে কষ্ট।
ঝুঁকির কারণ ও কারা বেশি বিপদে?
কিডনি রোগ হওয়ার সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয় এমন বিষয়গুলো:
- ডায়াবেটিস (Uncontrolled blood sugar)-সবচেয়ে বড় কারণগুলোর একটি।
- উচ্চ রক্তচাপ (Hypertension)-কিডনির রক্তনালী ও ফিল্টার নষ্ট করতে পারে।
- বয়স বাড়লে (বড় মানুষের ক্ষেত্রে) কিডনির কার্যক্ষমতা ধীরে ধীরে কমে যায়।
- বংশগত কারণ -পলিসিস্টিক কিডনি রোগ ইত্যাদিতে জিনের ভূমিকা।
- অতিরিক্ত ওষুধ ব্যবহার (ননস্টেরয়ডাল অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি ড্রাগস, কিছু পেইনকিলার ইত্যাদি)
- খাদ্যাভ্যাস: উচ্চ লবণ, অতিরিক্ত প্রোটিন, ফসফরাস এবং পটাশিয়াম বেশি খাওয়া
- পানির অভাব, দীর্ঘ সময় ডিহাইড্রেশন হওয়া
- পরিবেশগত কারণ: আর্সেনিক বা দূষিত পানির ব্যবহারে কিডনিতে ক্ষতি হতে পারে।
কিভাবে নির্ণয় করা হয়?
নিচের পরীক্ষাগুলো সাধারণত করা হয়:
- রক্ত পরীক্ষা (Blood test): ক্রিয়েটিনিন (Creatinine), রক্তে ইউরিয়া, estimated GFR (eGFR) যা দেখায় কিডনির ফিল্টারিং ক্ষমতা কতটা আছে।
- মূত্র পরীক্ষা (Urine test): প্রোটিন, অ্যালবুমিন, রক্ত থাকছে কি-না, ইউরিনে ফোম দেখা যাচ্ছে কি-না ইত্যাদি।
- ইমেজিং পরীক্ষা: আলট্রাসাউন্ড, সিটি স্ক্যান বা এমআরআই — কিডনির আকার, কাঠামো, পাথর বা সিস্টের জন্য।
- রক্তচাপ ও রক্তে গ্লুকোজ (সুগার) নিয়মিত পরীক্ষা:কারণ এইগুলো কিডনির ক্ষতি বাড়ায়।
কিডনি রোগ প্রতিরোধের উপায়
এগুলো অনুসরণ করলে কিডনির রোগ হওয়া থেকে অনেকটাই রক্ষা পাওয়া যেতে পারে:
- স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস বজায় রাখা:
• লবণ (নুন) কম খাওয়া
• প্রোটিনের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করা; অতিরিক্ত প্রোটিন অতিরিক্ত কাজ যোগায়।
• ফসফরাস এবং পটাশিয়াম সমৃদ্ধ খাবার সযত্নে খাওয়া, বিশেষত রোগের ধাপ পৌঁছালে ডাক্তার পরামর্শ অনুযায়ী।
• প্রচুর তাজা ফল ও সবজি খাওয়া।
- পর্যাপ্ত হাইড্রেশন (পানি পান করা): প্রতিদিন পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করুন, বিশেষত গরম বা শারীরিক পরিশ্রমের সময়।
- নিয়মিত ব্যায়াম ও শারীরিক কার্যকলাপ: হাঁটা, হালকা ঘোরাঘুরি, ইয়োগা ইত্যাদি - রক্তচাপ ও ওজন নিয়ন্ত্রণে কাজে লাগে।
- রক্তচাপ ও শর্করা নিয়ন্ত্রণ করা: ডায়াবেটিস থাকলে নিয়মিত ডাক্তার দেখানো, ওষুধ ঠিকভাবে খাওয়া, খাদ্য ও জীবনযাপন পরিবর্তন করা।
- অতিরিক্ত ওষুধ এড়িয়ে চলা: বিশেষত পেইনকিলার, ওভার-দ্য-কাউন্টার ওষুধ, কিছু অ্যান্টিবায়োটিক etc.
- নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা: যাঁরা ঝুঁকিতে আছেন (ডায়াবেটিস, হাই ব্লাড প্রেশার, বয়স্ক মানুষ) তাঁদের প্রতি-বছর রক্ত ও মূত্র পরীক্ষার মাধ্যমে কিডনির ফাংশন মাপা উচিত।
- জীবনযাপন পরিবর্তন: ধূমপান ত্যাগ, অতিরিক্ত মদ এড়িয়ে চলা, স্ট্রেস কম করা, ভালো ঘুম নিশ্চিত করা।
চিকিৎসা ও তত্ত্বাবধান
যদি কিডনি রোগ ধরা পড়ে, তাহলে নিম্নলিখিত চিকিৎসা ও তত্ত্বাবধান হয়:
- ওষুধ: রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ, রক্তে শর্করা নিয়ন্ত্রণ, মূত্রনালির সংক্রমণ হলে সেই অনুযায়ী অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হয়।
- ডায়ালাইসিস: ESRD ধাপ পৌঁছালে, যেখানে কিডনি স্বাভাবিক কাজ করতে পারে না, তখন রক্ত থেকে বর্জ্য এবং অতিরিক্ত পানি সরাতে ডায়ালাইসিস প্রয়োজন হয়।
- কিডনি প্রতিস্থাপন (Kidney Transplant): যদি রোগ গুরুতর ও স্থায়ী হয় এবং দাতা পাওয়া যায়।
- পুষ্টি পরামর্শ: রেনাল ডায়েট (renal diet) অনুযায়ী খাবার পরিকল্পনা উচিত, ডাক্তার/নিউট্রিশনিস্টের পরামর্শে।
- মনিটরিং: নিয়মিত রক্ত ও মূত্র পরীক্ষা, ইলেকট্রোলাইট (পটাশিয়াম, ফসফরাস, সোডিয়াম) নিয়ন্ত্রণ, রক্তচাপ ও গ্লকোজ ফলো-আপ।
বাংলাদেশি প্রেক্ষাপটে কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক
বাংলাদেশে কিডনি রোগের সমস্যা এবং প্রতিরোধের ক্ষেত্রে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ:
- অনেক মানুষ সচেতন নয়; মুখে কথা শুনে অবহেলা হয়, লক্ষণ দেখা দিলে বড় ধাপে চলে আসে। গবেষনায় দেখা গেছে ঢাকা শহরের সাধারণ মানুষের মধ্যে CKD সম্পর্কে জ্ঞান ও মনোভাব উন্নয়নের প্রয়োজন।
- কিছু এলাকায় পানির লবণাক্ততা ও দূষিত পানি কিডনির জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।
- বিলাসবহুল চিকিৎসা সব জায়গায় সহজলভ্য নয়, দাম ও সুযোগ সীমিত হতে পারে; বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায়।
- সরকার ও স্থানীয় স্বাস্থ্য সংস্থাগুলোকে সচেতনতা বাড়াতে, বিনামূল্যে বা সাশ্রয়ি CKD স্ক্রিনিং ক্যাম্প ও ক্লিনিক পরিচালনা করতে হবে।
বাংলাদেশ সম্পর্কিত কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ও উৎস
- প্রাদুর্ভাব / Prevalence of CKD
বাংলাদেশে সাধারণ মানুষের মধ্যে Chronic Kidney Disease-এর প্রাদুর্ভাব প্রায় ২২.48%। মেয়েদের ক্ষেত্রে একটু বেশি, পুরুষের তুলনায়।
- মৃত্যু ও রোগ সংখ্যা
প্রতি বছর বাংলাদেশে প্রায় ১৭,০০০ জন মানুষ কিডনি রোগের কারণে মারা যায়। রোগ রয়েছে প্রায় ১২.৯ মিলিয়ন (প্রায় নয়-দশ মিলিয়ন) মানুষের মধ্যে কোনো না কোনো ধরনের কিডনি সমস্যা।
- কিডনি ফেলিওর ও চিকিৎসার খরচ ও চ্যালেঞ্জ
বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ৩৫,০০০-৪০,০০০ নতুন কিডনি ফেলিওর (kidney failure) রোগী হয়। CKD রোগীদের মধ্যে অনেকেই ধরা পড়েন রোগের অগ্রগতি বেশ বেশি হলে। ডাক্তার ও স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান থেকে ডায়ালাইসিস / কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট গ্রহণ করতে পারা সব ক্ষেত্রে সহজ নয়, এবং খরচও অনেক বেশী।
- ডায়েট ও খাদ্যাভাসের নির্দেশনা
রোগী-উপযোগী renal diet-ে সাধারণত নুন (sodium), ফসফরাস, পটাশিয়াম এবং প্রোটিনের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়। প্রক্রিয়াজাত খাবার ও অতিরিক্ত লবণযুক্ত খাবার এড়িয়ে চলা উচিত।
পরামর্শ
- রোগের প্রাথমিক ধাপেই সচেতন হওয়া সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। লক্ষণগুলো পাওয়া মাত্রই ডাক্তার দেখানো উচিত।
- প্রতিদিনের ছোট-ছোট অভ্যাস পরিবর্তন (খাদ্য, পানি, ব্যায়াম) অনেক দূর এগিয়ে দিতে পারে।
- নিজের দেহের সংবেদনশীল হোন; শরীর যদি বলে “কিছু ঠিক নেই” — ঘুম, অতিরিক্ত ক্লান্তি, প্রস্রাব পরিবর্তন, ফুলে যাওয়া — এগুলো সব চিহ্ন হতে পারে।
- সরকার ও স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানগুলোর স্ক্রিনিং ক্যাম্প ও সচেতনতামূলক কর্মসূচিতে অংশ নিন ও অন্যদের জানিয়ে দিন।
FAQ / সাধারণ জিজ্ঞাসা
প্রশ্ন: কিডনি রোগ কি পুরুষের বেশি হয় নাকি মহিলার?
উত্তর: উভয়েরই হতে পারে, তবে পরিসংখ্যান অনুযায়ী পুরুষদের মধ্যে কিছু ঝুঁকি বেশি হতে পারে, কারণ পুরুষরা ধূমপান, উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে অবাঞ্ছিত জীবনধারা বেশি করে থাকতে পারে।
প্রশ্ন: যদি লক্ষণ না থাকে, কীভাবে জানব?
উত্তর: নিয়মিত রক্ত ও মূত্র পরীক্ষা করা সবচেয়ে ভালো উপায়। যদি আপনি ঝুঁকিতে থাকেন (ডায়াবেটিস, হাই ব্লাড প্রেশার, বংশগত ঘটনা) তাহলে বছরে অন্তত একবার বা তার বেশি পরীক্ষা করান।
প্রশ্ন: কিডনি রোগে খাবার কি সম্পূর্ণ বন্ধ করতে হয়?
উত্তর: না, সম্পূর্ণ বন্ধ নয়; তবে রোগের ধাপ ও শরীরের অবস্থা অনুযায়ী ডাক্তারের ও পুষ্টিবিদের পরামর্শ অনুযায়ী খাদ্য নিয়ন্ত্রণ করতে হবে-যেমন লবণ ও ফসফরাস কম, প্রোটিন সমন্বিত উপযোগী মাত্রায়।
Tags:
#Kidney
#Kidney Disease
#Health
#Disease Prevention
#Symptoms
#Chronic Kidney Disease
#Acute Kidney Injury
#Nephrology
#Healthy Lifestyle